বিশেষ প্রতিনিধি
অনুসারীদের সাফ বলে দিয়েছেন, বাড়াবাড়ি করবে না। কোন কিছু হলে আমি দায়ী নই। এ কথা শুনে অনুগতরাও চুপসে গেছে। ক’দিন আগেও যারা লম্ফঝম্ফ করতো তারা এখন বিনা কারনে বাড়ি থেকে বেরই হচ্ছে না। বদলে গেছে আচরণও। এরই মধ্যে অনেক ঘটনা প্রবাহ বদলে গেলেও চিন্তা কমেনি ওসমান পরিবারের। দীর্ঘ রাজনৈতিক পথে হাঁটতে হাঁটতে এবার অন্য রকম এক হোচট খেয়ে চিন্তিত তারা।
রাজনীতির ঐতিহ্যে ওসমান পরিবার নিয়ে গর্ব রয়েছে এ পরিবারের সদস্যদের। একই পরিবারের দাদা.বাবা, নাতি জনপ্রতিনিধি হওয়ার বিষয়টি দেশতো বটেই উপ মহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে তৃতীয় প্রজন্মে এসে নানা কলঙ্কের দাগও লেগেছে এ পরিবারে।
এরশাদ সরকারের আমলে জোড়া খুনের মধ্য দিয়ে যা শুরু হয়। ওই সময়ে চাষাঢ়ায় খুন হয় শহরের আরেক প্রভাবশালী পরিবার তারু সরদারের ছেলে কামাল ও আরেক যুবক কালাম। এ দুই খুনের জন্য অভিযোগের তীর আসে ওসমান পরিবারের তৎকালিন ৪ সিপাহশালারের একজন সারোয়ারের বিরুদ্ধে। জোড়া মার্ডারের পর শহরে বেশ আলোড়ন হয়। কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দা এক হয়ে ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। এক পর্যায়ে এ পরিবারের সদস্য ও তাদের অনুগতরা বাধ্য হয় শহর ছাড়তে। তবে তখন নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টির এমপি থাকায় সেই যাত্রায় রক্ষা পায় তারা।
২০০১ সালে পরিবারটি আবারও চাপে পড়ে। তবে এর আগে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত গোটা জেলা দাবড়ে বেড়ায় তাদের অনুগতরা। আওয়ামীলীগের ওই সময়কালে নারায়ণগঞ্জ-৪ থেকে এমপি হন শামীম ওসমান। নানা ঘটনায় তখন আলোচিত-সমালোচিত হন তিনি ও তার বলয়। বিশেষ করে পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠা নানা নামের-নানা রঙ্গের সন্ত্রাসী বাহিনী পালনের অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। এক একজন এক এক সেক্টর দখল করে ছিলো। তাদের হুকুমে চলতে হতো মানুষকে। এক পর্যায়ে ‘গডফাদার’ উপাধি জুটে তার বরাতে। তবে বিএনপি জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশ ছেড়ে বিদেশ যেতে হয় শামীম ওসমানকে।
২০০৯ এ আওয়ামীলীগ ফের ক্ষমতায় এলে দেশে ফিরেন তিনি। তবে সে মেয়াদে তার সাংসদ হওয়ায় হয়নি। দেশে এসে কিছুদিন চুপচাপ থাকলেও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাস ভাড়া নিয়ে সমালোচনায় আসেন তিনি। বাস ভাড়া বাড়ানোর পর যাত্রি অধিকার নিয়ে একটি সংগঠন আন্দোলন শুরু করে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসন সম্মেলন কক্ষে একটি মিটিংয়ে বাস মালিকদের পক্ষ নিয়ে শামীম ওসমান তার রাজনৈতিক গুরু আনোয়ার হোসেন ও তৎকালিন সাংসদ সারাহ বেগম কবরীর দিকে তেড়ে যান। টেলিভিশনে এর ভিডিও চিত্র সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে আবারও সারা দেশে সমালোচিত হন শামীম ওসমান। ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর কাছে বিপুল ভোটে হেরে রাজনৈতিক পথে হারার সূচনা করেন শামীম ওসমান।
এরপর ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা। দলের হলেও মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগেন তিনি ও তার অনুসারীরা। যার শেষ ঘন্টা বাজে গত বছর ১৬ জানুয়ারি। এদিন হকার ইস্যু নিয়ে মেয়র আইভীর উপর হামলে পড়েন কতক মানুষ। যারা শামীম ওসমানের অনুগত হিসেবে পরিচিত। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, এ ঘটনার প্রেক্ষিতে দলে শামীম ওসমানের অবস্থান নাজুক হয়। জেলা আওয়ামীলীগের কমিটিতে তার বলয়ের নেতারা পদ পান কম। আর সম্প্রতি হারুন অর রশিদ পুলিশ সুপার হিসেবে নারায়ণগঞ্জে যোগ দিয়ে বদলে দেন রাজনীতির চিত্র। অতীতে যারা পুলিশ সুপার হিসেবে আসতেন তাদের সবাই ওসমান পরিবারকে সমীহ করতেন। এবারই এর উল্টো ঘটে। এসপি হারুন এ জেলায় আসার পরই একের পর এক গ্রেপ্তার হয় শামীম ওসমানের অনুসারীরা।
কেউ চাঁদাবাজি, কেউ সন্ত্রাসীর অভিযোগে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। জিডি, মামলা হয় তার তার অনুগত ও আত্মীয়ের বিরুদ্ধে। প্রথমদিকে স্বভাবজাত ভঙ্গিতে শামীম ওসমান ধমক দিলেও তাতে সফল হননি তিনি। এসপিকে দেখাতে নিজ বলয় নিয়ে একটি সমাবেশও করেন এই নেতা। এরপরও থামেনি পুলিশ। অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নিয়েছেন। এক সময়ে আল্টিমেটাম দিয়ে বলয়ে নিজের ভাব ধরে রাখতে চাইলেও তা কাজে আসেনি। ১০/১২ দিন সময় পার হয়ে গেলেও তিনি কিছুই করতে পারেননি। উল্টো বাংলা নববর্ষ অনুষ্ঠানে এসপির আমন্ত্রনে গিয়ে নিজের ধরে রাখা ভাবকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন বলে মনে করে রাজনৈতিক বোদ্ধারা।
ওই অনুষ্ঠানে যাওয়ার কয়েক দিনের মাথায় শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন ও ডিশ ব্যবসার গডফাদার হিসেবে পরিচিত আব্দুল করিম বাবুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একাধিক মামলার এই আসামী এখনও কারাগারে। তবে সম্প্রতি আরও একটি অনুষ্ঠানে এসপির সাথে শামীম ওসমানের হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে অনেকে। কেউ বলছেন, দু’জনের সম্পর্ক মধুর হয়ে গেছে। কেউ বলছেন, সম্পর্ক যা-ই থাকুক এসপি হারুন ছাড় দেয়ার পাত্র নয়।
এদিকে অবস্থা এমন দেখে নিজের অনুগতদের চুপ থাকতে বলেছেন শামীম ওসমান। সূত্র জানায়, তার অনুগত বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের উঠতি নেতাদের ডেকে তিনি বলে দিয়েছেন, এমন কিছু করবানা যাতে সমস্যা সৃষ্টি হয়। বাড়াবাড়ি করলে, কিছু হলে আমি দায়ী নই। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, এক সময় এ শহর পেরিয়ে জেলার দন্ডমুন্ডের কর্তা বলা হতো শামীম ওসমানকে। তবে এই মুহূর্তে কিছুটা নাজুক অবস্থানে আছেন তিনি ও তার পরিবার। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কপালে।
তবে এ কথা মানতে নারাজ ওসমান পরিবার বলয়। তাদের মতে, নারায়ণগঞ্জে এখনো এই পরিবারের উপর কোন রাজনৈতিক পরিবার নেই। তাদের যেমন ঐতিহ্য আছে তেমনি ভবিষ্যতও আছে।